🛑বাংলাদেশে এনজিওদের কর কাঠামো: আয়কর ও মূসক আইনের আলোকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের সমাজ উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) গুলো অসামান্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে, কর বিষয়ক দায়বদ্ধতা ও কর অব্যাহতির সুযোগগুলো সম্পর্কে অনেক এনজিও সঠিক ধারণা রাখেন না। আয়কর আইন, ২০২৩ এবং মূসক আইন, ২০১২ অনুসারে এনজিওদের কর কাঠামো বিশ্লেষণ করাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
🛑আয়কর আইন, ২০২৩ অনুযায়ী কর অব্যাহতি
২০২৩ সালে প্রণীত নতুন আয়কর আইনটি ১৯৮৪ সালের পুরনো অধ্যাদেশকে প্রতিস্থাপন করেছে। এই আইনের আওতায় এনজিওগুলোকে সাধারণত “কোম্পানি” হিসেবে গণ্য করা হলেও, নির্দিষ্ট কিছু আয়কর ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে:
✅অনুদান ও দানে কর অব্যাহতি
- ষষ্ঠ তফসিলের প্রথম ভাগের ধারা ১২ অনুসারে, ট্যাক্স কমিশনার কর্তৃক অনুমোদিত ধর্মীয় বা জনহিতৈষী প্রতিষ্ঠানের অনুদান বা দান করযোগ্য আয়ের বাইরে থাকবে।
- NGOAB (এনজিও বিষয়ক ব্যুরো) অনুমোদিত সংগঠনের প্রাপ্ত অনুদান, যদি তা নির্ধারিত জনসেবামূলক কাজে ব্যবহার করা হয়, তবে সেগুলোও করমুক্ত থাকবে।
তবে, ধারা ৭৬(৫) ও ৭৬(৬) অনুযায়ী অপ্রদর্শিত আয় সংক্রান্ত বিধান প্রযোজ্য থাকবে।
✅অনুমোদন অপরিহার্য
কর অব্যাহতি পেতে হলে, সংশ্লিষ্ট এনজিওকে অবশ্যই ট্যাক্স কমিশনার বা NGOAB এর অনুমোদন প্রাপ্ত হতে হবে।
✅আয়ের সঠিক ব্যবহার
কর অব্যাহতি শুধুমাত্র তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন অনুদান বা দান শুধু ধর্মীয় বা জনহিতৈষী কার্যক্রমে ব্যবহার করা হবে। অন্য উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যবহার করলে কর ছাড় বাতিল হতে পারে।
✅মাইক্রোক্রেডিট আয়
যদি মাইক্রোক্রেডিট আয় শুধুমাত্র একটি Revolving Fund-এ রাখা হয় এবং সেই তহবিল কেবল ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা কর অব্যাহতির আওতায় আসতে পারে। তবে, অন্য কোনো বাণিজ্যিক খাতে এই আয় ব্যবহৃত হলে কর প্রযোজ্য হবে।
✅অন্যান্য আয়
ভাড়া, ব্যাংক সুদ, ট্রেনিং ফি বা অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রম হতে প্রাপ্ত আয় সাধারণত করযোগ্য।
✅রিটার্ন দাখিল ও রিপোর্টিং বাধ্যবাধকতা
NGOAB অনুমোদিত সকল এনজিওকে বছরে একবার কর রিটার্ন দাখিল করতে হয় এবং সকল রিপোর্টিং শর্ত পালন করতে হয়, এমনকি কর না দিলেও।
🛑দাতাদের জন্য কর কর্তনযোগ্য অনুদান
আয়কর আইন, ২০২৩ অনুসারে, নির্দিষ্ট কিছু সরকারি অনুমোদিত এনজিওতে দান করলে, সেই অনুদান দাতার করযোগ্য আয় থেকে কর্তনযোগ্য হতে পারে।
🛑যোগ্য অনুদানসমূহ:
- শহর কর্পোরেশনের বাইরে পরিচালিত অনুমোদিত চ্যারিটেবল হাসপাতাল
- প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান (NBR ও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত)
- জাকাত তহবিলে অনুদান (জাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ অনুসারে)
- সরকার কর্তৃক অনুমোদিত শিক্ষা বা জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে অনুদান
🛑 পূর্ব-অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান উদাহরণস্বরূপ:
- মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
- আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক
- আহসানিয়া ক্যান্সার হাসপাতাল
- এশিয়াটিক সোসাইটি
- ICDDR,B
- সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (CRP)
🛑 শর্তসমূহ:
- যথাযথ অনুমোদন থাকতে হবে
- রসিদ ও প্রমাণপত্র থাকতে হবে
- কর কর্তনযোগ্য অনুদানে আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশের সীমা থাকতে পারে
🛑বাংলাদেশে এনজিওদের মূসক (VAT) কাঠামো
মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী, প্রায় সকল সেবার উপর ১৫% মূসক ধার্য। তবে এনজিও হওয়ার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূসক ছাড় পাওয়া যায় না।
✅সাধারণ মূসক অব্যাহতি নেই
শুধু এনজিও হওয়ার কারণে কোনো Blanket VAT Exemption নেই।
✅ছাড়প্রাপ্ত পণ্য ও সেবা
VAT আইনের প্রথম তফসিলে উল্লিখিত কিছু সেবা যেমন:
- শিক্ষা
- স্বাস্থ্য
- নির্দিষ্ট কৃষিপণ্য — এসব ক্ষেত্রে এনজিও মূসক ছাড় পেতে পারে, তবে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের জন্য।
✅মূসক উৎসে কর্তন (VDS)
NGOAB বা সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর অনুমোদিত NGO VAT উৎসে কর্তন করতে বাধ্য, অর্থাৎ তারা মূসক সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করে।
✅আমদানি মূসক
সাধারণত এনজিওদের আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ১৫% মূসক প্রযোজ্য। তবে, যদি কোনো SRO (Special Regulatory Order) দ্বারা ছাড় দেয়া হয়, তাহলে তা প্রযোজ্য হবে।
✅প্রকল্প-ভিত্তিক মূসক অব্যাহতি
বিশেষ কিছু দাতাসংস্থা অর্থায়িত বা সরকার অনুমোদিত প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে NBR অনুমোদিত হলে সুনির্দিষ্ট VAT ছাড় পেতে পারে।
🛑উপসংহার:
বাংলাদেশে NGOদের জন্য কর কাঠামো বহুমাত্রিক ও বিস্তারিত।
- অনুদান ও দানে কর ছাড়ের সুযোগ রয়েছে, তবে অনুমোদন ও উদ্দেশ্য ভিত্তিক ব্যবহার অপরিহার্য
- দাতাদের জন্য কর কর্তনযোগ্য দানের সুবিধা আছে
- মূসক ছাড় নির্ভর করে কার্যক্রমের ধরন ও আইনি অনুমোদনের ওপর
🛑কর ছাড় কোনো “স্বয়ংক্রিয় অধিকার” নয়; বরং এটি নিয়মিত পরিপালন, অনুমোদন ও স্বচ্ছতা-ভিত্তিক একটি সুবিধা।
সঠিক কর পরিকল্পনা ও পরামর্শের জন্য অভিজ্ঞ কর আইনজীবীর সহায়তা নেওয়া সবসময় বাঞ্ছনীয়।