বাংলাদেশে গ্রেফতার, রিমান্ড ও হেফাজতের আইনগত বিধানসমূহ
প্রধান আইনি উৎসঃ
বাংলাদেশে গ্রেফতার, রিমান্ড ও হেফাজত সংক্রান্ত বিধানসমূহ মূলত নিম্নোক্ত দুটি আইনে পাওয়া যায়—
✅দণ্ডবিধি (Code of Criminal Procedure, 1898 – CrPC) ✅গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
এছাড়াও উচ্চ আদালতের দিকনির্দেশনা ও Torture and Custodial Death (Prevention) Act, 2013–এর মতো বিশেষ আইনগুলোও এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে গ্রেফতার (Arrest in BD)
কখন একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা যায়?
✅ওয়ারেন্ট সহ গ্রেফতারঃ
সাধারণত আদালতের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানার (Warrant) মাধ্যমে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।
(দণ্ডবিধির ৭৫ ধারা)
✅ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতারঃ
বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াও গ্রেফতার করতে পারে—
(দণ্ডবিধির ৫৪ ধারা অনুযায়ী), যেমন:
✅কেউ একটি গম্ভীর অপরাধে (cognizable offence) যুক্ত বলে সন্দেহ হলে।
✅ব্যক্তি চুরি বা ঘরে চুরির সরঞ্জাম বহন করছে এবং তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নেই।
✅আদালত বা সরকার কর্তৃক ঘোষিত দোষী ব্যক্তি।
✅সন্দেহভাজনভাবে চুরি হওয়া মালপত্র বহন করছে।
✅পুলিশ কর্মকর্তার কাজে বাধা দিলে বা হেফাজত থেকে পালিয়ে গেলে।
✅সশস্ত্র বাহিনী থেকে পলায়নকারী (deserter) সন্দেহে।
✅বিদেশে সংঘটিত অপরাধে অভিযুক্ত, যার জন্য বাংলাদেশে বিচার হতে পারে বা প্রত্যর্পণযোগ্য।
✅শর্তসাপেক্ষে মুক্তিপ্রাপ্ত অপরাধী, যদি ৫৬৫(৩) ধারার বিধান লঙ্ঘন করে।
✅অন্য পুলিশ অফিসার লিখিতভাবে অনুরোধ করলে, এবং আইনসম্মতভাবে গ্রেফতার করা যায় এমন তথ্য থাকলে।
গ্রেফতার করার পদ্ধতি (Section 46, CrPC)
✅পুলিশ অফিসারকে ব্যক্তিকে স্পর্শ বা হেফাজতে নিতে হবে; যদি ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ না করে।
✅প্রতিরোধ করলে প্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ করা যায়, তবে প্রাণঘাতী বল কেবলমাত্র মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দণ্ডযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যাবে।
✅গ্রেফতারের কারণ জানানো বাধ্যতামূলক (সংবিধান ৩৩(১) ধারা)।
✅অপর অফিসারের আদেশে গ্রেফতার হলে, আদেশের বিবরণ জানাতে হবে ও অনুরোধ করলে তা দেখাতে হবে (CrPC ৫৫ ধারা)।
✅পুলিশ অফিসারকে পরিচয় দিতে হবে এবং চাওয়া হলে আইডি কার্ড প্রদর্শন করতে হবে (উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী)।
✅থানায় আনার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতারের কারণ, অপরাধের বিবরণ ও তথ্যের উৎস রেকর্ড করতে হবে এবং এক কপি আসামিকে দিতে হবে।
✅ঘরের বাইরে গ্রেফতার হলে, নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে ফোন বা বার্তার মাধ্যমে জানাতে হবে।
✅গ্রেফতারের পর আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ দিতে হবে। (সংবিধান ৩৩(১) এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা)
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির অধিকারসমূহ
✅Arrest কারণ জানার অধিকার (সংবিধান ৩৩(১) ধারা)
✅আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের অধিকার (সংবিধান ৩৩(১) ধারা)
✅২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার অধিকার (CrPC ৬১ ধারা ও সংবিধান ৩৩(২))
✅আত্মস্বীকৃতি দিতে বাধ্য না হওয়ার অধিকার (সংবিধান ৩৫(৪) ধারা)
✅স্বাস্থ্য পরীক্ষার অধিকার, বিশেষ করে নির্যাতনের অভিযোগ থাকলে
✅জামিনের আবেদন করার অধিকার (অপরাধের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে)
রিমান্ড ও হেফাজতের আইন
⭕️রিমান্ড কী?
রিমান্ড হলো—আদালতের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুলিশ বা জেল হেফাজতে রেখে অধিকতর তদন্ত চালানোর অনুমতি।
আইনি ভিত্তি: দণ্ডবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী।
⭕️রিমান্ড সংক্রান্ত আইন (CrPC 167 ধারা)
✅২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে।
✅মামলা ডায়েরির কপি আদালতে উপস্থাপন করতে হবে।
✅পুলিশ হেফাজতের সর্বোচ্চ মেয়াদ: ১৫ দিন (একত্রে বা একাধিক মেয়াদে)।
✅অতিরিক্ত হেফাজত কেবল জেল হেফাজতের মাধ্যমে হতে পারে, এবং উপযুক্ত যুক্তি থাকতে হবে।
✅গুরুতর অপরাধে (মৃত্যুদণ্ড/জীবন কারাদণ্ড/১০ বছরের বেশি দণ্ডযোগ্য): সর্বোচ্চ তদন্তকালীন হেফাজত ১২০ দিন।
✅অপেক্ষাকৃত কম অপরাধে: সর্বোচ্চ ৬০ দিন; অতঃপর জামিনের অধিকার জন্মায়।
✅রিমান্ড মঞ্জুর করলে ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখিত কারণ দেখাতে হবে (CrPC ৩৪৪ ধারা)।
✅রিমান্ডের আদেশের কপি প্রধান মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা জজ বরাবর পাঠাতে হবে (CrPC ১৯৩(৪এ) ধারা)।
⭕️রিমান্ড ও সংবিধানগত বিষয়সমূহ
✅সন্দেহ নয়, বরং সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার হওয়া উচিত।
✅পুলিশকে প্রমাণ করতে হবে কেন ২৪ ঘণ্টায় তদন্ত শেষ হয়নি এবং তথ্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য।
✅জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি গ্রহণ আদালতে অগ্রহণযোগ্য (সংবিধান ৩৫(৪) ধারা)।
✅নির্যাতনের মাধ্যমে তথ্য আদায় সংবিধান পরিপন্থী।
⭕️রিমান্ডের অপব্যবহার প্রতিরোধে সুরক্ষা ব্যবস্থা
সংবিধানগত সুরক্ষা:
✅সংবিধান ৩৫(৫): নিষ্ঠুর ও অমানবিক নির্যাতনের নিষেধাজ্ঞা।
⭕️আইনি সুরক্ষা:
✅Torture and Custodial Death (Prevention) Act, 2013 অনুযায়ী নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা।
⭕️উচ্চ আদালতের নির্দেশনাঃ (BLAST মামলা)
✅রিমান্ডের আগে ও পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
✅রিমান্ড চলাকালে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ।
⭕️প্রক্রিয়াগত সীমাবদ্ধতা:
✅পুলিশ হেফাজত সর্বোচ্চ ১৫ দিন।
✅আদালতের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ বাধ্যতামূলক।
হেফাজতের ধরণ
⭕️পুলিশ হেফাজত:
✅তদন্তের প্রয়োজনে থানায় রাখা হয়।
✅আদালতের আদেশে ১৫ দিনের বেশি নয়।
✅বিচারিক হেফাজত (জেল):
✅১৫ দিন পর বা বিচার চলাকালীন জেল হেফাজতে রাখা হয়।
⭕️ হেফাজতের আইনগত বিধান
আদালতের আদেশ ছাড়া কোনো হেফাজত বৈধ নয় (CrPC ১৬৭, সংবিধান ৩৩(২) ধারা)।
✅গুরুতর অপরাধে: তদন্তকালীন সর্বোচ্চ ১২০ দিন।
✅অন্যান্য ক্ষেত্রে: সর্বোচ্চ ৬০ দিন।
হেফাজতে নির্যাতন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
⭕️ হেফাজতে থাকা ব্যক্তির অধিকারসমূহ
সংবিধানিক অধিকার:
✅জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার (সংবিধান ৩২ ধারা)
✅আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের অধিকার (৩৩ ধারা)
✅নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা (৩৫(৫) ধারা)
✅ন্যায্য বিচারের অধিকার (৩৫ ধারা)
অতিরিক্ত অধিকার:
⭕️মানবিক আচরণ:
✅পর্যাপ্ত খাদ্য, চিকিৎসা, পরিচ্ছন্নতা
✅পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের অধিকার
✅বেআইনি হেফাজতের বিরুদ্ধে হেবিয়াস কর্পাস রিট দায়েরের অধিকার (সংবিধান ১০২ ধারা)
⭕️উপসংহার
বাংলাদেশে Arrest, রিমান্ড ও হেফাজত সংক্রান্ত আইনসমূহ ব্যক্তি অধিকার ও অপরাধ দমন—উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখার জন্য প্রণীত। তবে এসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ, বিচারিক তত্ত্বাবধান ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে অপব্যবহারের ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও জনগণের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।