বাংলাদেশে তালাক দেওয়ার নিয়ম ও প্রক্রিয়া (২০২৫ আপডেট)
Divorce Law & Procedure in Bangladesh
বাংলাদেশে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ (Dissolution of Marriage) হলো মুসলিম পারিবারিক আইনের অধীনে স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক বৈধভাবে বিবাহ বন্ধন শেষ করার একটি আইনগত প্রক্রিয়া।
এই প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে “তালাক নোটিশ” প্রদান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা এবং নির্দিষ্ট সময় পর তা কার্যকর হয়।
তালাক কী?
তালাক (Talaq) হলো মুসলিম স্বামী কর্তৃক তার স্ত্রীকে বৈধভাবে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করার ঘোষণা। এটি ইসলামী শরীয়ত ও Muslim Family Laws Ordinance, 1961 অনুযায়ী একটি আইনি স্বীকৃত প্রক্রিয়া।
মুসলিমদের তালাক দেওয়ার নিয়ম (Divorce Process for Muslims in Bangladesh)
বাংলাদেশে মুসলিমদের তালাক প্রক্রিয়া Muslim Family Laws Ordinance, 1961-এর ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। এটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়
ধাপ ১: তালাকের লিখিত ঘোষণা
স্বামীকে প্রথমে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লিখিতভাবে তালাকের ঘোষণা দিতে হয়।
এতে অবশ্যই স্বামীর নাম, স্ত্রীর নাম, বিবাহের তারিখ ও তালাকের কারণ উল্লেখ থাকবে।
ধাপ ২: ইউনিয়ন পরিষদে তালাক নোটিশ পাঠানো
লিখিত ঘোষণার পর স্বামীকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (বা শহরে হলে পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন) বরাবর তালাক নোটিশ পাঠাতে হয়।
একই সঙ্গে স্ত্রীর কাছেও একটি কপি পাঠানো বাধ্যতামূলক।
এই নোটিশে নিম্নলিখিত তথ্য থাকতে হবে:
- স্বামী ও স্ত্রীর নাম ও ঠিকানা
- বিবাহের তারিখ
- তালাকের তারিখ ও কারণ
ধাপ ৩: সালিশি পরিষদ (Arbitration Council) গঠন
নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান ৩০ দিনের মধ্যে একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবেন।
এই পরিষদ স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয় এবং সমঝোতার চেষ্টা করা হয় যাতে তালাক রোধ করা যায়।
ধাপ ৪: ৯০ দিনের অপেক্ষাকাল (Iddat Period)
তালাক ঘোষণার দিন থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত (বা স্ত্রীর গর্ভাবস্থার শেষ পর্যন্ত) তালাক কার্যকর হয় না।
এই সময়ে সালিশি পরিষদ চেষ্টা করবে সমঝোতা করার।
ধাপ ৫: তালাক কার্যকর হওয়া
যদি ৯০ দিনের মধ্যে সমঝোতা না হয়, তাহলে মেয়াদ শেষে তালাক কার্যকর হয়ে যায়।
চেয়ারম্যান তখন উভয় পক্ষকে জানিয়ে দেন যে তালাক এখন আইনত কার্যকর হয়েছে।
তালাক নোটিশ কখন দিতে হয়?
তালাক নোটিশ দিতে হয় তালাক ঘোষণার সাথে সাথেই। অর্থাৎ, স্বামী “তালাক” উচ্চারণ বা লিখিত ঘোষণা দেওয়ার পরই চেয়ারম্যান বরাবর নোটিশ পাঠাতে হবে। এই নোটিশ না পাঠালে তালাক আইনগতভাবে কার্যকর হবে না, এমনকি মৌখিক তালাকও বৈধ নয়।
স্ত্রী কি তালাক দিতে পারে? (Right of Wife to Divorce)
হ্যাঁ, মুসলিম স্ত্রীরও তালাকের অধিকার আছে যদি তাকে “তালাক-তাফওয়িজ (Delegated Divorce)” অধিকার দেওয়া থাকে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন কাবিননামায় (Clause No. 18)। এছাড়াও, স্ত্রী Family Court Ordinance, 1985 অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে “Khula” (খুলা তালাক) আবেদন করতে পারেন, যদি স্বামী তালাক দিতে অস্বীকৃতি জানান।
তালাকের পর সন্তান কার কাছে থাকবে? (Child Custody After Divorce)
বাংলাদেশে সন্তানের হেফাজত নির্ধারণ হয় Guardian and Wards Act, 1890 অনুযায়ী। সাধারণত আদালত সন্তানের কল্যাণ (Welfare) বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেন। ছোট শিশুদের (বিশেষ করে মেয়ে শিশু) সাধারণত মায়ের কাছে থাকে। বয়স্ক ছেলে শিশুদের বাবার কাছে দেওয়া হতে পারে।
তালাক কার্যকর হওয়ার সময়কাল
বাংলাদেশে তালাক একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা অনুসারে কার্যকর হয়। প্রথমে স্বামী তালাকের ঘোষণা দেন এবং সেই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর নোটিশ পাঠান — এটি প্রথম দিন (Day 1) হিসেবে গণ্য হয়। এরপর চেয়ারম্যান ৩০ দিনের মধ্যে একটি সালিশি পরিষদ (Arbitration Council) গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করা।
তালাক ঘোষণার পর থেকে শুরু হয় ৯০ দিনের অপেক্ষাকাল বা ইদ্দত সময়, যার মধ্যে যদি সালিশি পরিষদের মাধ্যমে সমঝোতা না হয়, তাহলে মেয়াদ শেষে তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর (Effective) হয়। অর্থাৎ, ৯০ দিন শেষে যদি কোনো পুনর্মিলন না ঘটে, তবে তালাক আইনত সম্পন্ন ও বৈধ বলে গণ্য হয়।
তালাক প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
তালাক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের প্রয়োজন হয়। প্রথমত, বিবাহ নিবন্ধন সনদ (Nikahnama) প্রয়োজন, যা বিবাহের বৈধতা প্রমাণ করে। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) লাগে উভয় পক্ষের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য।
তালাকের জন্য একটি লিখিত তালাক ঘোষণা পত্র তৈরি করতে হয়, যেখানে বিবাহের তথ্য ও তালাকের কারণ উল্লেখ থাকে। চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো তালাক নোটিশের রশিদ সংরক্ষণ করতে হয়, কারণ এটি আইনগত প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া প্রয়োজনে সাক্ষীদের নাম ও তথ্য সালিশি পরিষদের শুনানিতে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
অবৈধ তালাকের উদাহরণ
বাংলাদেশে তালাক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইনগত ধাপ অনুসরণ না করলে সেটি অবৈধ ও অকার্যকর (Invalid Divorce) হিসেবে গণ্য হয়। যেমন— শুধুমাত্র মৌখিকভাবে “তালাক” বলা আইনত বৈধ নয়। একইভাবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর নোটিশ না পাঠালে, বা ৯০ দিনের অপেক্ষাকাল শেষ হওয়ার আগে নতুন বিয়ে করলে, সেটিও অবৈধ তালাক হিসেবে ধরা হয়।
অর্থাৎ, তালাককে কার্যকর করতে হলে অবশ্যই লিখিত ঘোষণা, চেয়ারম্যানকে নোটিশ প্রেরণ, সালিশি পরিষদের গঠন এবং ৯০ দিনের অপেক্ষাকাল— এই সব ধাপ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক।
গুরুত্বপূর্ণ টিপস
তালাক একটি সংবেদনশীল সামাজিক ও আইনগত প্রক্রিয়া, তাই আবেগ নয়— বুদ্ধি ও আইনি সচেতনতা দিয়ে এটি সম্পন্ন করা উচিত। প্রথমে পারিবারিকভাবে সমঝোতার চেষ্টা করা সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ।
তালাকের নোটিশ পাঠানোর পর সব নথি ও রশিদ সংরক্ষণ করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কোনো আইনি জটিলতা না হয়।
প্রয়োজনে পারিবারিক আদালতের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে খোরপোষ, দেনমোহর বা সন্তানের হেফাজত সংক্রান্ত বিষয়ে। সন্তানদের অভিভাবকত্ব ও কল্যাণ সংক্রান্ত যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একজন অভিজ্ঞ ফ্যামিলি ল’ (Family Law) আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
তালাক সংক্রান্ত সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
বাংলাদেশে তালাক কার্যকর হতে কত দিন লাগে?
তালাক কার্যকর হতে সাধারণত ৯০ দিন সময় লাগে, যা “ইদ্দত সময়” নামে পরিচিত।
এই সময় সালিশি পরিষদ সমঝোতার চেষ্টা করে, এবং যদি কোনো সমঝোতা না হয়, তবে ৯০ দিন শেষে তালাক স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়।
শুধু “তালাক” বলে দিলেই কি তালাক হয়ে যায়?
না । শুধুমাত্র মুখে “তালাক” বলা বা এসএমএস/ফোনে ঘোষণা দেওয়া আইনগতভাবে বৈধ নয়।
তালাক বৈধ হতে হলে অবশ্যই লিখিত ঘোষণা দিতে হবে এবং ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বরাবর তালাক নোটিশ পাঠানো বাধ্যতামূলক।
স্ত্রী কি তালাক দিতে পারে?
হ্যাঁ । মুসলিম নারী তালাক-তাফওয়িজ (Delegated Divorce) অধিকার থাকলে নিজে তালাক দিতে পারেন।
এছাড়া Family Court এর মাধ্যমে খুলা (Khula) তালাকের আবেদন করেও বিবাহ বিচ্ছেদ করা যায়, যদি স্বামী তালাক দিতে অস্বীকৃতি জানান।
তালাকের পর স্ত্রী খোরপোষ পাবে কি?
হ্যাঁ। স্ত্রী ইদ্দত সময়ের মধ্যে খোরপোষ (Maintenance) পাওয়ার অধিকার রাখে।
তাছাড়া, দেনমোহর, যৌতুক, সন্তান লালন-পালনের খরচ ইত্যাদিও আদালতের মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব, Family Court Ordinance, 1985 অনুযায়ী।
তালাকের পর সন্তান কার কাছে থাকবে?
সন্তানের হেফাজত নির্ধারণ হয় Guardian and Wards Act, 1890 অনুযায়ী।
সাধারণত ছোট শিশু ও কন্যা সন্তান মায়ের কাছে থাকে, তবে আদালত সন্তানের কল্যাণ (Welfare) বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
তালাকের পর পুনরায় বিয়ে করা যাবে কবে?
তালাক কার্যকর হওয়ার পর (অর্থাৎ ৯০ দিন শেষে) স্ত্রী যদি ইদ্দত সময় শেষ করেন, তখনই তিনি পুনরায় বিয়ে করতে পারবেন।
ইদ্দতের সময় গর্ভবতী হলে, সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ইদ্দত শেষ হয়।
তালাকের সময় আইনজীবী নেওয়া কি বাধ্যতামূলক?
না, তবে একজন অভিজ্ঞ ফ্যামিলি ল’ আইনজীবী নেওয়া অত্যন্ত উপকারী।
তিনি তালাক নোটিশ প্রস্তুত, সালিশি পরিষদে অংশগ্রহণ ও খোরপোষের বিষয়ে আইনি সহায়তা দিতে পারেন।
যদি স্বামী তালাক নোটিশ না পাঠায়, তাহলে কী হবে?
যদি স্বামী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর তালাক নোটিশ না পাঠান, তাহলে সেই তালাক আইনগতভাবে অবৈধ (Invalid) হবে।
এই ক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতে অভিযোগ করতে পারেন, এবং তালাকের বৈধতা নিয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেবে।
তালাকের রেজিস্ট্রেশন কোথায় করতে হয়?
তালাকের নোটিশ পাঠানোর পর চেয়ারম্যানের অফিসেই তালাক রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়।
তালাক কার্যকর হওয়ার পর উভয় পক্ষই চেয়ারম্যান অফিস থেকে তালাক সনদ (Divorce Certificate) সংগ্রহ করতে পারেন।
তালাকের সময় দেনমোহর কিভাবে আদায় করা যায়?
তালাকের সময় স্ত্রী তার দেনমোহর ও অন্যান্য পাওনা Family Court-এ মামলা করে আদায় করতে পারেন।
আইন অনুযায়ী স্বামী তালাকের সময় স্ত্রীকে দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য।
