গৃহনির্যাতন আইন বাংলাদেশ – নারী সুরক্ষা ও আইনি প্রতিকার
গৃহনির্যাতন আইন বাংলাদেশে – নারী সুরক্ষার এক শক্তিশালী হাতিয়ার
বাংলাদেশে গৃহনির্যাতন (Domestic Violence) বলতে বোঝায় — স্বামী, পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক কোনো নারী বা শিশুর উপর শারীরিক, মানসিক, যৌন বা অর্থনৈতিক নির্যাতন।
গৃহনির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীর সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার প্রণয়ন করেছে
“গৃহনির্যাতন (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০”।
এই আইন অনুযায়ী, নারী ও শিশুরা পরিবারের ভিতরে সংঘটিত যেকোনো নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন।
গৃহনির্যাতনের সংজ্ঞা (Definition of Domestic Violence)
“Domestic Violence” বলতে বোঝায়—
কোনো ব্যক্তি তার পারিবারিক সম্পর্কের অন্য সদস্যের প্রতি শারীরিক, মানসিক, যৌন বা অর্থনৈতিক ক্ষতি বা নির্যাতন করলে সেটি গৃহনির্যাতন হিসেবে গণ্য হবে।
গৃহনির্যাতনের ধরন
- শারীরিক নির্যাতন: মারধর, আঘাত, শারীরিক ক্ষতি।
- মানসিক নির্যাতন: অপমান, ভয় দেখানো, চরিত্র হনন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
- যৌন নির্যাতন: জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা যৌনভাবে নির্যাতন।
- অর্থনৈতিক নির্যাতন: স্ত্রীর সম্পত্তি ব্যবহার থেকে বিরত রাখা, ভরণপোষণ না দেওয়া, চাকরি করতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি।
স্ত্রী বা ভুক্তভোগীর আইনি অধিকার
গৃহনির্যাতনের শিকার স্ত্রী বা নারী আত্মীয় নিম্নলিখিত অধিকার পেতে পারেন —
- সুরক্ষা আদেশ (Protection Order): আদালত নির্যাতনকারীকে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে দূরে থাকতে আদেশ দিতে পারেন।
- বাসস্থান আদেশ (Residence Order): স্ত্রীকে তার নিজের ঘর থেকে জোর করে বের করে দেওয়া যাবে না।
- ভরণপোষণ আদেশ (Maintenance Order): স্ত্রী আর্থিক সহায়তা পাওয়ার অধিকার রাখেন।
- ক্ষতিপূরণ আদেশ (Compensation): মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির জন্য আদালত ক্ষতিপূরণ দিতে পারেন।
গৃহনির্যাতন অভিযোগ দায়েরের নিয়ম
ধাপে ধাপে অভিযোগ করার প্রক্রিয়া
অভিযোগ গ্রহণকারী অফিস:
- থানায় (নারী ও শিশু নির্যাতন সেল)
- মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
- ইউনিয়ন পরিষদ / পৌরসভা অফিস
- সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আবেদন
অভিযোগে যা উল্লেখ থাকবে:
- নির্যাতনের ধরন ও সময়
- নির্যাতনকারীর নাম ও সম্পর্ক
- সাক্ষী বা প্রমাণ (ছবি, রিপোর্ট, প্রতিবেশী সাক্ষ্য ইত্যাদি)
আদালতের ভূমিকা:
আদালত তাৎক্ষণিকভাবে Protection Order দিতে পারেন এবং তদন্তের নির্দেশ দেন।
সময়কাল:
সাধারণত ৩০ দিনের মধ্যে শুনানি সম্পন্ন হয়।
আইন অনুযায়ী শাস্তি
গৃহনির্যাতনের অপরাধে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
আদেশ অমান্য করলে অতিরিক্ত ৬ মাসের কারাদণ্ড হতে পারে।
| অধিকার | ব্যাখ্যা |
|---|---|
| দেনমোহর (Mahr) | কাবিনে নির্ধারিত দেনমোহর সম্পূর্ণ দাবি করতে পারেন। |
| ভরণপোষণ (Maintenance) | তালাক কার্যকর হওয়া পর্যন্ত এবং ইদ্দত সময়ের জন্য ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার আছে। |
| মেয়ের হেফাজত (Custody of Child) | ছোট সন্তানের হেফাজত সাধারণত মা পান। |
| উত্তরাধিকার (Inheritance) | যদি স্বামী মারা যান তালাক কার্যকর হওয়ার আগে, তবে স্ত্রী উত্তরাধিকার পাবেন। |
বিবাহ বাতিলের নিয়ম (Marriage Annulment in Bangladesh)
Marriage Annulment বা বিবাহ বাতিল হয় যখন কোনো বিবাহ শুরু থেকেই আইনত অবৈধ বা ত্রুটিপূর্ণ হয়।
কোন অবস্থায় বিবাহ বাতিল হতে পারে:
জোরপূর্বক বিবাহ (consent ছাড়া)
- বিবাহের সময় এক পক্ষের মানসিক অক্ষমতা
- বয়সসীমা পূর্ণ না হওয়া
- ইতোমধ্যে বিবাহিত থাকা অবস্থায় পুনরায় বিয়ে
- প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে বিয়ে
প্রক্রিয়া:
ভুক্তভোগী পরিবার আদালতে বিবাহ বাতিলের মামলা (Suit for Annulment) দায়ের করতে পারেন।
আদালত প্রমাণের ভিত্তিতে বিবাহ শুরু থেকেই অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন।
পরিবার মামলা (Family Case) দায়েরের প্রক্রিয়া
বাংলাদেশে পরিবার-সংক্রান্ত যেকোনো মামলা (তালাক, ভরণপোষণ, হেফাজত, দেনমোহর, উত্তরাধিকার ইত্যাদি) Family Court Ordinance, 1985 অনুযায়ী দায়ের করা হয়।
ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া:
- অভিযোগপত্র (Plaint) তৈরি করে পরিবার আদালতে জমা দিন।
- প্রতিপক্ষকে নোটিশ পাঠানো হয়।
- উভয় পক্ষের শুনানি ও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়।
- আদালত রায় প্রদান করেন এবং কার্যকর আদেশ দেন।
আদালত সাধারণত ভুক্তভোগীর স্থায়ী ঠিকানার Family Court (Assistant Judge Court) এ মামলা গ্রহণ করেন।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: গৃহনির্যাতন আইন কাদের জন্য প্রযোজ্য?
উত্তর: এটি পরিবারের যেকোনো নারী বা শিশুর জন্য প্রযোজ্য — স্ত্রী, মা, বোন, মেয়ে বা গৃহপরিচারিকা।
প্রশ্ন ২: নির্যাতনের প্রমাণ না থাকলে কি মামলা করা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, সাক্ষী বা পরিস্থিতিগত প্রমাণের ভিত্তিতেও আদালত মামলা গ্রহণ করতে পারে।
প্রশ্ন ৩: Protection Order ভাঙলে কী শাস্তি হয়?
উত্তর: আদেশ অমান্য করলে ৬ মাস পর্যন্ত জেল বা ১০,০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে।
প্রশ্ন ৪: তালাকের পরও কি স্ত্রী নির্যাতনের মামলা করতে পারেন?
উত্তর: হ্যাঁ, তালাকের আগের বা পরের নির্যাতনের ঘটনাও মামলা করা যায়।
প্রশ্ন ৫: আইনজীবী ছাড়া অভিযোগ করা যায় কি?
উত্তর: হ্যাঁ, ভুক্তভোগী নিজেই থানায় বা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আবেদন করতে পারেন।
উপসংহার
গৃহনির্যাতন আইন শুধু নারী নয়, পরিবারের সব সদস্যের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য তৈরি।
যে কোনো নির্যাতনের শিকার হলে ভয় না পেয়ে নিকটস্থ থানায়, ইউনিয়ন পরিষদ বা আদালতে অভিযোগ করুন।
মনে রাখবেন — নীরবতা নির্যাতনকে উৎসাহ দেয়, আর আইনি পদক্ষেপ দেয় সুরক্ষা ও সম্মান।
