দ্বিতীয় বিয়ে করার নিয়ম ও শর্ত (বাংলাদেশে মুসলিমদের জন্য)
বাংলাদেশে মুসলিম পুরুষদের একাধিক বিয়ে করার অনুমতি ইসলামী শরীয়তে থাকলেও, এটি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং শর্তসাপেক্ষ। আইন অনুযায়ী, যথাযথ অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে সেটি অবৈধ নয়, তবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়।
চলুন জেনে নিই বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কিত আইন, শর্ত ও করণীয় বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে।
দ্বিতীয় বিয়ে সংক্রান্ত মূল আইন
বাংলাদেশে মুসলিম পরিবারের বিয়ে, তালাক ও অন্যান্য বিষয় পরিচালিত হয় “Muslim Family Laws Ordinance, 1961” অনুযায়ী।
এই আইনের Section 6 এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে:
কোনো পুরুষ তার বর্তমান স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থায় পরিবার আদালতের অনুমতি ও পূর্ববর্তী স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবেন না।
দ্বিতীয় বিয়ে করার ধাপসমূহ
- লিখিত আবেদন জমা দিতে হবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভায় : আবেদনে বর্তমান স্ত্রীর নাম, ঠিকানা ও দ্বিতীয় বিয়ের কারণ উল্লেখ করতে হয়।
- আরবিট্রেশন (সালিশ) বোর্ড গঠন করা হয়: বোর্ডে একজন চেয়ারম্যান ও উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা থাকেন।
- স্ত্রীর সম্মতি ও কারণ যাচাই: বোর্ড বিবাহের কারণ ও স্ত্রীর সম্মতি যাচাই করে।
- বোর্ড অনুমতি দিলে দ্বিতীয় বিয়ে বৈধভাবে সম্পন্ন করা যায়: অনুমতি ছাড়া বিয়ে করলে আইনি জটিলতা তৈরি হয়।
দ্বিতীয় বিয়েতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
প্রথম স্ত্রীর লিখিত সম্মতি (অথবা না দেওয়ার কারণ উল্লেখ)
- চেয়ারম্যান বা পৌর মেয়রের কাছে আবেদনপত্র
- আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র
- পূর্ববর্তী বিবাহের কাবিননামা কপি
- সাক্ষীর তথ্য ও বিবাহ প্রমাণপত্র
স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে কী হয়?
যদি কেউ স্ত্রীর সম্মতি ও সালিশ বোর্ডের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তাহলে—
- তিনি ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
- প্রথম স্ত্রী চাইলে তালাক বা ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন।
- কাবিননামা বৈধ থাকলেও বিবাহ নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল হতে পারে।
| পরিস্থিতি | আইনগত অবস্থা |
|---|---|
| স্ত্রীর সম্মতি ও বোর্ডের অনুমতি সহ বিয়ে | বৈধ |
| স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া কিন্তু বোর্ড অনুমতি দিয়েছে | বৈধ |
| কোনো অনুমতি ছাড়াই গোপনে বিয়ে | শাস্তিযোগ্য অপরাধ |
| প্রথম স্ত্রী মৃত বা তালাকপ্রাপ্ত | অনুমতি প্রয়োজন নেই |
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ
ইসলাম অনুযায়ী একজন পুরুষ সর্বোচ্চ চারটি স্ত্রী রাখতে পারেন, তবে শর্ত হলো—
“যদি তোমরা ন্যায়বিচার করতে পারবে বলে মনে করো।”
(সূরা নিসা, আয়াত ৩)
অর্থাৎ, সকল স্ত্রীকে সমান অধিকার, ভরণপোষণ ও সম্মান দিতে পারার সামর্থ্য না থাকলে দ্বিতীয় বিয়ে নিরুৎসাহিত।
দ্বিতীয় বিয়ের পর উত্তরাধিকার আইন
বাংলাদেশে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, সকল বৈধ স্ত্রী তাদের স্বামীর সম্পত্তিতে সমান অংশে উত্তরাধিকার পান।
উদাহরণ:
- যদি কারো দুইজন স্ত্রী থাকে, তাহলে উভয় স্ত্রী ১/৮ অংশ সমানভাবে ভাগ করে পাবেন, যদি সন্তান থাকে।
- সন্তান না থাকলে উভয়েই ১/৪ অংশ ভাগাভাগি করে পাবেন।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: দ্বিতীয় বিয়ে করতে কি প্রথম স্ত্রীর লিখিত অনুমতি লাগবে?
উত্তর: হ্যাঁ, আইন অনুযায়ী প্রথম স্ত্রীর সম্মতি ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের অনুমতি আবশ্যক।
প্রশ্ন ২: প্রথম স্ত্রী যদি অনুমতি না দেন, তাহলে কী হবে?
উত্তর: আবেদন সালিশ বোর্ডে গেলে বোর্ড যৌক্তিক কারণ বিবেচনা করে অনুমতি দিতে পারে।
প্রশ্ন ৩: স্ত্রীর অনুমতি থাকলেও কি কোর্টে যেতে হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভায় সালিশ বোর্ডের অনুমতি প্রয়োজন।
প্রশ্ন ৪: দ্বিতীয় বিয়ে করলে কাবিননামা আলাদা হয় কি?
উত্তর: হ্যাঁ, প্রত্যেক বিয়ের জন্য আলাদা কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন করতে হয়।
প্রশ্ন ৫: দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান কি প্রথম স্ত্রীর সন্তানের মতো উত্তরাধিকার পাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, ইসলামিক উত্তরাধিকার আইনে সকল বৈধ সন্তান সমান অধিকার পায়।
উপসংহার
বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিয়ে করা শুধু ধর্মীয় অনুমতির বিষয় নয়, বরং একটি আইনগত প্রক্রিয়া। যথাযথ অনুমতি, সম্মতি ও রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বিয়ে করলে তা আইন লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হয় এবং এর জন্য শাস্তি রয়েছে।
তাই দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে সব নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে কোনো আইনি জটিলতা বা পারিবারিক সমস্যা তৈরি না হয়।
